December 23, 2024, 3:04 am

গলাচিপায় নীলপাগলের দল

(পটুয়াখালী) প্রতিনিধি
  • Update Time : Friday, April 14, 2023,
  • 103 Time View
OLYMPUS DIGITAL CAMERA

চৈত্র মাস এলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে নীল পাগলের দল। যেখানে শিবকে সাজানো হয় পাগলের সাজে। সারা শরীরে যার মাছ ধরার জাল পেছানো।

তার নিচে ছেড়া টুকরো কাপড় চোপড়। মাথায় লম্বা চুল। মুখে ঘন সাদাকালো লম্বা দাড়ি গোঁফ। চোখে কালো চশমা। হাতে কাঠের তরবারি। মাথায় লাল জবা। পায়ে ঘুঙুর। এই যে শিবের রূপ। তা কিন্তু নিরর্থক কোন বেশ নয়। সাজসজ্জার প্রতিটি উপকরণই যথেষ্ট অর্থবোধক।

নীল পাগল কেন বলা হয়? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলে শিবের এই অদ্ভদ সাজসজ্জার কারণ কিছুটা হলেও জানা যাবে। বাকিটা না হয় পরে বুঝিয়ে বলা হবে। অনেকেই বলেন, শিবের আরেক নাম নীলকণ্ঠ। তাই নীল পাগল বলা হয়। বিষয়টি আসলে ততটা সহজ নয়, যতটা সহজ ভাবা হয়। নীল পাগল শব্দের উৎস সন্ধানের আগে ভেবে নেয়া ভালো, শিব বলতেই আমরা কিন্তু একা শিবকে মেনে নিতে পারি না। শিব মানেই পাবর্তী। যেখানে শিব, সেখানেই সতী। দুর্গার একনিষ্ঠ স্বামী। যুগল রূপে দেখতেই আমরা অভ্যস্ত। এই যে যুগল রূপ, তা কিন্তু শেষ পযর্ন্ত ঠেকেনি। সতীকে নিয়ে দক্ষযজ্ঞ ঘটে গেল। একান্ন পিঠের আবির্ভাব হলো।

তবে কী শিব একা হয়ে গেল! তবে যে আমরা আদর্শ দম্পতির কথা বলি, তা কী শুধুই কথার কথা! যে কোন নারীর আরাধ্য- শিবের মতো স্বামী, তাও কী শুধু লোক দেখানো! না, মোটেই তা নয়! শিবের জন্য এখানে দাঁড়িয়ে আছেন আরেক সতী। যিনি দুর্গারই প্রতিরূপ।

বলে নেয়া ভালো আমাদের গ্রাহাস্থ্য জীবনে যে ক’জন লোকদেবতা আছেন, তাদের শীর্ষে আছেন মহামহিম শিব। এক শিবকে নিয়ে যত লোককথা প্রচলিত আছে, তা একজন মানুষের সারা জীবনে সংগ্রহ এবং গ্রন্থিত করা সম্ভব নয়। আর গ্রন্থিত করা গেলেও তা মহাভারতকে ছাড়িয়ে যাবে নিঃসন্দেহে। এমনই এক লোককথার মতে, শিবজায়া সতী পরবর্তী জন্মে আবির্ভূতা হন নীলাবতী নামে। দক্ষযজ্ঞে সতীর মৃত্যুর পরে একদিন নীলধ্বজ রাজা তার বাগানে বেল গাছের তলায় এক অপরূপ সুন্দরী কন্যা সন্তান দেখতে পান। রাজা বুঝতে পারেন, এই মেয়েই আসলে দেবী সতী! তাকে নিজের মেয়ের মতো করে বড় করে তোলেন রাজা।

পরে শিবের সঙ্গে বিয়ে হয় নীলাবতীর। এই বিয়ের ঘটকালী করেছিলেন স্বয়ং নারদ। এখানেই সতীর পুনর্জন্মে পার্বতী হয়ে জন্ম নিয়ে শিবের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পৌরাণিক গল্পের সঙ্গে আলাদা হয়ে গিয়েছে বাংলার লোককাহিনি। কিন্তু এর পরেও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। নীলাবতীই কি দেবী ষষ্ঠী? না হলে এই দিনটাকে নীল ষষ্ঠী বলা হবে কেন? অনেকের মতে, আসলে ষষ্ঠীই এসেছিলেন নীলাবতী রূপে। ষষ্ঠীর উল্লেখ কিন্তু পুরাণে পাওয়া যায়। তিনি আদি শক্তির অংশ, তাই তাঁকে দুর্গা বা আদ্যাশক্তির একটি রূপ হিসেবেই ধরা হয়। সুতরাং নীলাবতী একই সঙ্গে সতী অথবা ষষ্ঠী দু’জনেরই রূপ হিসেবে কল্পিত হতে পারেন।

প্রধানত সন্তানের কল্যাণের জন্যই ষষ্ঠীর পূজা প্রচলিত বাংলা বিহার ওডিশা এবং উত্তর প্রদেশের কিছু জায়গায়।

নীলপূজার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অসংখ্য আচার। আর এসব আচার নীলপূজার সঙ্গে লোক সংস্কৃতির যোগ প্রমাণ করে দেয়। নীলষষ্ঠী কেন্দ্র করে বাংলায় প্রচলিত রয়েছে বহু লোকগান। সুন্দরবন এলাকার বালা গান কিংবা অন্য বহু জেলায় প্রচলিত অষ্টক গান নীলাবতী আর শিবের বিয়েকে ছন্দে বেঁধেছে। যা বাংলার একান্তই নিজস্ব এক সংস্কৃতি।

নীলপূজা কিন্তু সাদামাটা কোন পূজা নয়। পুরো চৈত্র মাস সন্ন্যাস ব্রত ধারণ করে তবেই সংক্রান্তির তিন দিন ধরে পূজার আয়োজন করা হয়। ওই যে গাজন বা চড়ক পূজা বলা হয়, তাও ভিন্ন কিছু নয়। সবই শিবের পূজা। এরপরেও যদি ‘নীলপাগল’ এবং তার সাজসজ্জা নিয়ে কোন প্রশ্ন থাকে, তার উত্তর না হয় পরের কোন এক লেখায় দেয়া যাবে।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2024
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: রায়তা-হোস্ট
tmnews71